মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩৫ অপরাহ্ন
সাবরিনা ওবায়েদ আনিকা:
মহান আল্লাহর অসংখ্য অগণিত সৃষ্টির মধ্যে মানুষ হচ্ছে, সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষকে আল্লাহতায়ালা এমন একটি নেয়ামত দিয়েছেন, যা অন্য কোনো প্রাণীকে দেওয়া হয়নি। সেটা হচ্ছে, মানুষের মুখের ভাষা। ভাষা আল্লাহর দান, আল্লাহর সেরা নেয়ামত। ভাষা মনুষ্য পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়। কারণ, সব ভাষাই আল্লাহর দান ও তার কুদরতের নিদর্শন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ সুরা আর রুম : ২২
আল্লাহতায়ালা দুনিয়ায় কোটি কোটি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিপুণতার সঙ্গে প্রত্যেক মানুষকে অন্য মানুষ থেকে আলাদাভাবে সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে দিয়েছেন রঙের ভিন্নতা, ভাষার ভিন্নতা, দিয়েছেন রুচির বৈচিত্র্য। এর মাধ্যমেই আল্লাহর মহা কুদরত ও অপরূপ মহিমা ফুটে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরমাদ হয়েছে, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মোত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ সুরা হুজুরাত : ১৩
সুতরাং কোনো ভাষাকে হেয় জ্ঞান করা যাবে না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না এবং অবহেলা করা যাবে না। কেননা ভাষার স্রষ্টাও মহান আল্লাহ। তার সৃষ্টির অবমূল্যায়ন করা তার প্রতি অসম্মান প্রদর্শনেরই নামান্তর। আল্লাহতায়ালা মানুষের হেদায়েতের জন্য নবী-রাসুলদের পাঠিয়েছেন। তাদের ধর্মপ্রচারের প্রধান মাধ্যম ছিল দাওয়াত। এ জন্য ভাষার কোনো বিকল্প ছিল না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যার জন্য।’ সুরা ইবরাহিম : ৪
আল্লাহর নবী হজরত মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল ইবরানি। তাই এ ভাষায় তাওরাত নাজিল হয়। হজরত দাউদ (আ.)-এর গোত্রের ভাষা ছিল ইউনানি। তাই জাবুর ইউনানি বা আরামাইক ভাষায় অবতীর্ণ হয়। মহান আল্লাহ হজরত দাউদ (আ.)-কে দান করেছিলেন সুমধুর কণ্ঠস্বর। ফলে তার ওপর নাজিলকৃত কিতাব পাঠ করার সময়, তার কণ্ঠের মোহনীয় সুরের মূর্ছনায় আল্লাহর বাণী শোনার জন্য সাগরের মৎস্য প্রজাতি কিনারে এসে ভিড় জমাত। আবার হজরত সোলায়মান (আ.)-কে মহান আল্লাহ পশুপাখির ভাষাসহ সব জীবের ভাষা বোঝার জ্ঞান দিয়েছিলেন। যার মাধ্যমে আল্লাহর নবী হজরত সোলায়মান (আ.) তাদের শাসন করেছেন এবং তাদের কথাবার্তা শুনে বিবদমান বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিতেন অত্যন্ত সুচারুভাবে।
ধর্মপ্রচারে শুদ্ধ ভাষা ও সুন্দর বর্ণনার প্রভাব অনস্বীকার্য। নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন ‘আফসাহুল আরব’ তথা আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী। তাই বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলা নবী করিম (সা.)-এর সুন্নত। আল্লাহতায়ালা বনী ইসরায়েলের হেদায়েতের জন্য হজরত মুসা (আ.)-এর প্রতি অহি নাজিল করলেন। তাকে নবী-রাসুল হিসেবে ঘোষণা করলেন, তার ওপর তাওরাত কিতাব অবতীর্ণ করলেন। তখন তিনি তার ভাই হজরত হারুন (আ.)-কেও নবী হিসেবে ঘোষণার জন্য আল্লাহর সমীপে আবেদন করেন। কারণ তিনি ছিলেন বাগ্মী, শুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী এবং সুবক্তা, আর মুসা (আ.)-এর মুখে ছিল জড়তা। হজরত মুসা (আ.) কারণ হিসেবেও বলেছেন, ‘সে আমার অপেক্ষা বাকপটু।’ পবিত্র কোরআনে এই বর্ণনাটি এভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, হজরত মুসা (আ.) বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কর্ম সহজ করে দিন। আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। আমার জন্য দিন একজন সাহায্যকারী আমার স্বজনদের মধ্য থেকে; আমার ভাই হারুনকে; তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় করুন এবং তাকে আমার কর্মের অংশীদার করুন, যাতে আমরা আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে পারি প্রচুর; এবং আপনাকে স্মরণ করতে পারি অধিক; আপনি তো আমাদের সম্যক দ্রষ্টা।’ সুরা ত্বহা : ২৫-৩৬
প্রতিটি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতি ও বিশ্বাসের সঙ্গে স্বাধীনতা, স্বদেশপ্রেম ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা বিদ্যমান। এ ক্ষেত্রে ধর্মবিশ^াসের পার্থক্য কোনো বিভেদ বা বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করে না। তাই মুসলিম নাগরিকরা সবসময় মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়।
ভয়েস/আআ